

আব্দুস শহীদ শাকির
জকিগঞ্জ (সিলেট) প্রতিনিধি।
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা—বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত একটি অবহেলিত জনপদ। তিন দিক ঘেরা ভারতীয় সীমান্ত আর এক পাশে কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলা। এখানেই ভারত থেকে আগত বরাক নদীর মোহনায় জন্ম নিয়েছে সুরমা ও কুশিয়ারা—দুটি প্রধান নদী। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর ২২ কিলোমিটার অংশ সরাসরি সীমান্ত নদী হিসেবে পরিচিত, যা জকিগঞ্জের বারঠাকুরী ইউনিয়নের আমলসীদ থেকে শুরু হয়ে বিরশ্রী ইউনিয়নের লক্ষীবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত।এই কুশিয়ারা নদী এখন রূপ নিচ্ছে ভয়ংকর দানব রুপে!মানুষ,মাটি ও মানচিত্র গিলে খাওয়ার জন্য। লাখো মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে এই কুশিয়ারা! হাজারো মানুষের বসতবাড়ি নদীগর্ভে করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে! প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীর তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় ভয়াবহ ভাঙন। আমলসীদ থেকে লক্ষীবাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, বসতবাড়ি আর জনপদ একে একে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বহু পরিবার হারিয়েছে তাদের শেষ আশ্রয়, নিঃস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে দিগ্বিদিক শূন্যতায়।গত বছরের বন্যার কথা মনে পড়লেই মানুষের চোখে ঘুম আসে না! না জানি এবারের বন্যায় কি হয়! এখনো বেশিরভাগ ডাইক মেরামতের কাজ শেষ হয়নি।অথচ বর্ষা চলে আসছে, নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে, না জানি এবারের বন্যায় কি হয়!
১৯৯১ সালের পর কিছু এলাকায় ভাঙন রোধে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, পুরো সীমান্তজুড়ে সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে আজও বহু জনপদ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। বিশেষ করে জকিগঞ্জে সদর ইউনিয়নের লালগ্রাম, ফেউয়া, সেনাপতিরচক, রারাই, মুমিনপুর, মানিকপুর, বাখরশাল, ষরিসা, শষ্যকুড়ী ও ছবড়িয়া।জকিগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের মাইজকান্দি। খলাছড়া ইউনিয়নের, ভুইয়ারমুড়া,লোহারমল, কাপন,গাগলাজুর,বিরশ্রী ইউনিয়নের সোনাপুর, বড়পাথর,জামডহর গ্রামগুলোতে কার্যকর কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।উপরোক্ত জায়গাগুলোতে কিছু অর্থ বরাদ্দ হলেও কাজ হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ফলে এখনো প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি। কুশিয়ারা যেন এক অদৃশ্য দানবের মতো ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে জকিগঞ্জের মানুষ, মাটি ও মানচিত্রকে!রারাই গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট সাংবাদিক জুবায়ের আহমদ বলেন, “একসময় আমাদের গ্রাম অনেক বড় ছিল। নদীর ডাইক ছিল অনেক দূরে। বিশাল মাঠে খেলাধুলা করতাম, সাঁতরে নদী পার হতাম। এখন নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের ঘর পর্যন্ত চলে এসেছে।” তিনি আরও বলেন, “অনেকের বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তারা এখন অন্যের আশ্রয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।”পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ভাঙন ও বন্যা রোধে একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় দুই নদীর ১০৫ কিলোমিটার ড্রেজিং ও ৮ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের পরিকল্পনা রয়েছে। এর ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি প্রায় প্রস্তুত এবং শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।এই অব্যাহত ভাঙন শুধু স্থানীয় জনজীবনের জন্য হুমকি নয়,প্রশ্ন তুলছে জাতীয় নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিয়েও। সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা নদী যদি এভাবে গ্রাস করে ভুমি ও জনপদকে,তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানচিত্র যে বদলে যাবে, তা অমূলক শঙ্কা নয়।এখনই সময়—দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার। তা না হলে ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে—আমরা চোখের সামনে দেশকে ভাঙতে দেখেও চুপ করে বসেছিলাম।